বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৫৩ অপরাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
জীবনসঙ্গী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ভিন্ন ধর্মের মানুষকে পছন্দ ও বিয়ে আপনি করতে পারেন। ভিন্ন ধর্মের দু’জনের বিয়ে হলে বিয়ের পর স্বামীর ধর্মবিশ্বাস পালন করতে কোনো নারীকে বাধ্য করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে স্ত্রী কোন ধর্ম পালন করবেন তা তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত-উচ্চ আদালত এমনটিই সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।
ব্রিটিশ শাসনামলেই ব্রিটিশরা এই আইনটি তৈরি করে গেছে। যে কোনো ধর্মের লোকই ‘বিশেষ বিবাহ আইন, ১৮৭২’ (সংশোধিত ২০০৭) অনুযায়ী তার নিজ ধর্মের বাইরে যে কোনো ধর্মাবলম্বীকে ‘বিশেষ বিবাহ’ করতে পারবে। যে ব্যক্তি মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান, ইহুদি, পার্সি, বৌদ্ধ, শিখ বা জৈন এর কোনো একটির অনুসারী কিন্তু সে নিজ ধর্ম ভিন্ন অন্য ধর্মের কাউকে বিয়ে করতে চায়, সে ‘বিশেষ বিবাহ আইন, ১৮৭২’-এর অধীনে বিয়ে করতে পারে।
এই বিয়ে কাদের জন্য প্রযোজ্য, বিয়ে অনুষ্ঠানের শর্তাবলি কী, সম্পাদনের পদ্ধতি কী, কার দ্বারা এ বিয়ে সম্পাদিত হবে, এ বিয়ের ফলে জন্ম নেয়া সন্তান কোন ধর্মের পরিচয়ে বড় হবে, এ বিয়ের স্বামী বা স্ত্রী কোন ধর্ম অনুসরণ করবেন, এ বিয়ের ফলে উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে কে কতটুকু ভোগ করতে পারবেন-সে বিষয়গুলো পর্যায়ক্রমে নিচে তুলে ধরা হলো।
বিশেষ বিবাহ আইন, ১৮৭২-এর ২ ধারা অনুযায়ী বিয়ে অনুষ্ঠানের বেশ কিছু শর্ত রয়েছে। প্রথমত: বিয়ের সময় বিয়ের পক্ষগণের মধ্যে কারো কোনো জীবিত স্বামী বা স্ত্রী থাকতে পারবে না, অর্থাৎ, স্বামী বা স্ত্রী থাকা অবস্থায় কেউ বিশেষ বিবাহ আইনের অধীন বিশেষ বিবাহ করতে পারবে না। দ্বিতীয়তঃ বিবাহ করতে ইচ্ছুক পুরুষ ব্যক্তির বয়স ২১ বছর এবং নারীর বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হতে হবে। তৃতীয়ত ঃ পক্ষগণ রক্ত সম্পর্কের কেউ হতে পারবে না।
এ আইনের ৪ ধারায় বলা আছে, বিয়ের দুই পক্ষের মধ্যে যেকোনো একটি পক্ষ বিশেষ বিবাহ রেজিস্ট্রারের কাছে ১৪ দিন আগে বিয়ের নোটিশ পাঠাবেন অর্থাৎ বিয়ের আগ্রহ প্রকাশ করে পত্র দিবেন। যদি এই সময়ের মধ্যে কেউ আপত্তি না করে তবে বিয়ে সম্পন্ন করা যাবে।
এ আইনের ১১ ধারায় বলা আছে, বিয়ে সম্পন্ন করতে হবে রেজিস্ট্রার এবং ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরদানকারী তিনজন সাক্ষীর সামনে। বিয়ের দুই পক্ষ রেজিস্ট্রার ও তিনজন সাক্ষীর সামনে- “আমি ‘অমুক’ কে আইনত স্ত্রী/স্বামী হিসেবে গ্রহণ করছি- এই রকম ঘোষণা দেওয়ার সময়, ইসলাম ধর্মের ক্ষেত্রে নারী সাক্ষী হলে হবে না। এমনকি দুজন নারী সাাক্ষীও গ্রহণযোগ্য নয়। সাক্ষী ঠিকঠাক থাকলে এই আইনের অধীনে অনুষ্ঠিত বিয়ে রেজিস্ট্রি করা হয় এবং এ জন্য নির্দিষ্ট রেজিস্ট্রির বই আছে। আর দুই কপি ছবি, সাথে পরচিয়পত্রের ফটোকপি। এতেই হয়ে যাবে দুজনের বিয়ে। আমি এতক্ষণ বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পর্কে যা বলেছি এগুলো পালন না করলে বিয়েটি বাতিল হয়ে যাবে বলে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত রয়েছে যা ১৮ ডিএলআর ৫০৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে।
তবে এ ধরনের বিয়ের ফলে বেড়ে উঠছে নতুন একটি প্রজন্ম। যারা উত্তরাধিকার সূত্রে কোনো নির্দিষ্ট ধর্মীয় পরিচয় বহন করছে না। এই উত্তরাধিকারীদের মধ্যে আবার কেউ কেউ একটি ধর্ম বেছে নিচ্ছে। মা অথবা বাবার ধর্ম বিশ্বাস অনুযায়ী। আর এদের মধ্যে সম্পত্তি বন্টনের ক্ষেত্রে কিন্তু কোন নিয়ম নেই। কাজেই পিতা-মাতাকে মৃত্যুর আগেই বন্টন করে দিয়ে যেতে হয়। বিভিন্ন জেলা থেকেও ছেলেমেয়েরা আসে বিয়ে করতে। বিশেষ করে যারা দেশের বাইরে যেতে চায় তাদের আসতেই হয়।
একটি মজার এবং ব্যতিক্রমী বিষয় হচ্ছে বিশেষ বিবাহের সবকিছুই যখন এই আইনের অধীনে হচ্ছে, তখন বিবাহ বিচ্ছেদটা হচ্ছে অন্য আইনের অধীন। বিশেষ বিবাহ আইনের ১৭ ধারায় বলা আছে, এই আইনের অধীনে বিয়ে করলে বিয়ে বিচ্ছেদের সময় ১৮৬৯ সালের ‘ডিভোর্স আইনের’ মাধ্যমে বিচ্ছেদ সম্পাদন করতে হয়। প্রসঙ্গত, ১৮৬৯ সালের ডিভোর্স অ্যাক্ট খ্রিস্টানদের ডিভোর্সের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এ আইনের অধীনে বিয়ের ফলে জন্মগ্রহণকারী সন্তান যদি এ আইনের অধীনেই বিয়ের ইচ্ছা পোষণ করেন, তবে আইনগত বাঁধা নেই। এমনকি অন্য কোনো আইনে সম্পাদিত বিয়ের বৈধতাও ক্ষুণœ করবে না। আর এরকম বিয়ে ক্ষেত্রে যদি কেউ মিথ্যা ঘোষণা বা সত্যায়ন করেন তাহলে দন্ডবিধির ১৯৯ ধারায় অপরাধী বলে বিবেচিত হবেন।
লেখকঃ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইন গবেষক, মোবাইলঃ ০১৭১৬৮৫৬৭২৮, Email: seraj.pramanik@gmail.com